১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবি হত্যার ইতিবৃত্ত : নাঈমুল হোসেন চৌধুরী


১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যার ইতিবৃত্ত


[Image]





১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক একটি দিন দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযু্দ্ধের পর বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে,তখন বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের সমন্বয়ে এদিন রচিত হয় বাংলাদেশকে বুদ্ধিহীন করার নীল ষড়যন্ত্রের জাল পরাজয় নিশ্চিত জেনে এদেশকে একেবারে পঙ্গু করে দেয়ার হীন মানসিকতার বশবর্তী হয়ে পাকিস্তানীরা দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবিদের একে একে আটক করে হত্যা করে এই দিনে তাই এই দিনটি বিবেকবান বাংলাদেশী মাত্রই সবার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে ২৫শে ডিসেম্বর সেই কালরাত্রের পর থেকেই ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সারা দেশব্যাপী বুদ্ধিজীবিদের খুঁজে খুঁজে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময়কার বুদ্ধিজীবিদের হত্যার বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন ইংরেজী ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ঐসমস্ত ওয়েবসাইট থেকে কিছু অংশ সবার পড়ার সুবিধার জন্য বাংলায় অনুবাদ করছি এই সিরিজটাতে
…………… এটা এখন জ্ঞাত যে, ১২ই ডিসেম্বর রোববার,যখন ভারতীয় সারি ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল, একদল উচ্চপদস্থ পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের বেসামরিক সতীর্থরা শহরের প্রেসিডেন্সিয়াল বাসভবনে বৈঠকে বসে তারা গ্রেফতার হত্যা করার জন্য ২৫০ জন মানুষের নাম একত্র করে, যাদের মধ্যে ছিল ঢাকার পেশাজীবি শ্রেণীদের মধ্যে সেরা মানুষ যারা এরই মধ্যে গৃহযুদ্ধে নিহত হয়নি১৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন সই হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে আল-বদর রাজাকার নামের একটি সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত উগ্র ডানপন্থী মুসলিমদের মধ্য থেকে চিহ্ণিত কিছু লোক দ্বারা তাঁদের সোমবার মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয় উপদ্রুত ব্যক্তিদের দলবেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের একটি দুর্গম এলাকায়, যেখানে তাঁদের সমষ্টিগতভাবে হত্যা করা হয় ……………… (The Times, December 23, 1971)



ব্রিগেডিয়ার কাশেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল পাক সেনাবাহিনীর দুইজন প্রধান কর্মকর্তা যারা এসমস্ত বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকান্ড তদারক করত তৎকালীন মাদ্রাসা শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি মাওলানা আবদুল মান্নানের সাথে তারা নভেম্বরের কোন এক সময়ে মান্নানের বাসভবনে বৈঠক করেছিল এটা ছিল সম্ভবতঃ সেই বৈঠক, যেখানে বুদ্ধিজীবিদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়
জনৈক মফিজুদ্দিন (লাশবাহী যানের চালক)-এর স্বীকারোক্তিমতে, নিউইয়র্কের কুইনস শাখার উত্তর আমেরিকার ইসলামিক সংস্থা (ICNA)- প্রধান এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য এবং রেডিও পাকিস্তান এর সাবেক কর্মচারী আশরাফুজ্জামান খান  নিজের হাতে সাতজন শিক্ষককে গুলি করেমফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তির ফলে হতভাগ্য এসব শিক্ষকবৃন্দের ছিন্নভিন্ন শরীর রায়েরবাজারের জলাভূমি এবং মিরপুরের শিয়ালবাড়ির গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়তার ডায়েরীতে ২০জন শিক্ষক অন্যান্য বহু বাংলাদেশীর তালিকা ছিলপাকিস্তানীদের দোসর ১৬ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তালিকা তার ডায়েরীতে ছিল

আশরাফুজ্জামান খান  

শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দঃ
·         .এন.এম.মুনির চৌধুরী
·         ডঃ  জি.সি.দেব
·         মুফাজ্জল হায়দার চৌধুরী
·         আনোয়ার পাশা
·         জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা
·         আবদুল মুক্তাদির
·         ডঃ এ.এন.এম.ফয়জুল মাহি
·         ফজলুর রহমান খান
·         .এন.এম. মনিরুজ্জামান
·         ডঃ সিরাজুল হক খান
·         ডঃ শাহাদাত আলী
·         ডঃ এম. . খায়ের
·         .আর.খান কাদিম
·         মুহাম্মদ সাদেক
·         শরাফত আলী
·         গিয়াসউদ্দীন আহমেদ
·         আনন্দ পায়ান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
·         অধ্যাপক কাইয়ুম
·         হাবিবুর রহমান
·         শ্রী সুখ রঞ্জন সমাদ্দার

জাতীয় পরিষদের সদস্যবৃন্দ
·         মশিউর রহমান
·         আমজাদ হোসেন
·         আমিনুদ্দিন
·         নাজমুল হক সরকার
·         আবদুল হক
·         সৈয়দ আনোয়ার আলী
·         .কে.সরদার

সাংবাদিকবৃন্দের তালিকা
·         সিরাজউদ্দীন হোসেন
·         শহীদুল্লাহ্‌ কায়সার
·         খন্দকার আবু তালেব
·         নিজামউদ্দীন আহমেদ
·         এ. এন.এম.গোলাম মোস্তফা
·         শহীদ সাবের
·         শেখ আবদুল মান্নান (লাদু)
·         নাজমুল হক
·         এম আখতার
·         আবুল বাশার
·         চিশতী হেলালুর রহমান
·         শিবসাধন চক্রবর্তী
·         সেলিনা আখতার
চিকিৎসকদের তালিকা
·         মোঃ ফজলে রাব্বি
·         আবদুল আলীম চৌধুরী
·         সামসুদ্দীন আহমেদ
·         আজহারুল হক
·         হুমায়ুন কবির
·         সোলায়মান খান
·         কায়সার উদ্দীন
·         মনসুর আলী
·         গোলাম মর্তুজা
·         হাফেজ উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর
·         আবদুল জব্বার
·         এস.কে.লাল
·         হেম চন্দ্র বসাক
·         কাজী ওবায়দুল হক
·         মিসেস আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী
·         আলহাজ্ব মমতাজউদ্দীন
·         হাসিময় হাজরা
·         নরেণ ঘোষ
·         জিকরুল হক
·         শামসুল হক
·         এম. রহমান
·         . গফুর
·         মনসুর আলী
·         এস. কে.সেন
·         মফিজউদ্দীন
·         অমূল্য কুমার চক্রবর্তী
·         আতিকুর রহমান
·         গোলাম সারওয়ার
·         আর.সি. দাশ
·         মিহির কুমার সেন
·         সালেহ আহমেদ
·         অনিল কুমার সাহ
·         সুনীল চন্দ্র শর্মা
·         .কে.এম.গোলাম মোস্তফা
·         মকবুল আহমেদ
·         এনামুল হক
·         মনসুর (কানু)
·         আশরাফ আলী তালুকদার
·         লেফটেন্যান্ট জিয়াউর রহমান
·         লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জাহাঙ্গীর
·         বদিউল আলম
·         লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হাই
·         মেজর রেজাউর রহমান
·         মেজর নাজমুল ইসলাম
·         আসাদুল হক
·         নাজির উদ্দীন
·         লেফটেন্যান্ট নুরুল ইসলাম
·         কাজল ভদ্র
·         মনসুর উদ্দীন
শিক্ষাবিদবৃন্দের তালিকা
·         জহির রায়হান
·         পূর্ণেন্দু দস্তিদার
·         ফেরদৌস দৌলা
·         ইন্দু সাহা
·         মেহেরুন্নেসা

শিল্পী, পেশাজীবি প্রভৃতির তালিকা
·         আলতাফ মাহমুদ
·         দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা
·         জোগেশ চন্দ্র ঘোষ
·         ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
·         শামসুজ্জামান
·         মাহবুব আহমেদ
·         খুরশিদ আলম
·         নজরুল ইসলাম
·         মোজাম্মেল হক চৌধুরী
·         মহসিন আলী
·         মুজিবুল হক




আশরাফুজ্জামান খান-এর কুখ্যাত ডায়েরীর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা
আশরাফুজ্জামান খান কে? এটা এখন কেন গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা এখন তার ডায়েরীর বিষয়বস্তু জানি? অনুগ্রহ করে ধৈর্য্য ধরুন এবং এই লেখাটি পড়ুন আমি আপনাকে এই লোকের শাস্তিযোগ্যতা সম্বন্ধে আপনার নিজের উপসংহার টানার সুযোগ দেব
এটা ছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ আমাদের নয় মাস দীর্ঘ জ্বলন্ত রক্তক্ষয়ী দিনের চূড়ান্ত অধ্যায়ও বটে আমাদের অদম্য মুক্তি বাহিনী ভারতীয় সেনাদের যৌথ কর্তৃত্বের শক্তি ঢাকাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল কিন্তু যদিও অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সেনাদের সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছিল, ভুঁইফোর, যারা গণমানুষের ভাগ্য অস্বীকার করতে চেয়েছিল, তাদের মরণছোবল দেয়ার জন্য অপশক্তিরা গভর্ণর হাউজ কাজ করছিল জেনারেল নিয়াজী তার সাঙ্গ কুখ্যাত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, এবং তাদের প্রধান সাহায্যকারী মেজর সিদ্দিক সালেক দের সাথে জড়ো হয়ে বসে ছিল তারা সবেমাত্র একটি তালিকা পেল যা তারা আল-বদর আল-শামস-এর কাছ থেকে প্রত্যাশা করছিল নির্দয় আল-বদর বাহিনীর একজন কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান গভর্নর হাউজ-এর উচ্চ পদস্থদের সুবিধা জন্য সবেমাত্র বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে এটা ছিল বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা যাদের নির্মূল করার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল পরিকল্পনা ছিল তাঁদেরকে শীঘ্রই হত্যা করা যাতে করে যদি বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাদের কাজ করতে হবে সমস্ত লোকদের ছাড়া যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিটির কাঠামো পুনর্গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেএটা হত পাকিস্তানীদের বাংলাদেশের প্রতি আংশিক পদাঘাত, তা বলাই বাহুল্য
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের সেই ঘটনাবহুল সপ্তাহের এক মৃত রাতে আশরাফুজ্জামান খানের তালিকার অন্তর্ভুক্ত বহু বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তাঁদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলাই বাহুল্য যে, তাঁদের মধ্যে কেউই দিনের আলো দেখার জন্য বেঁচে থাকেননি এমনকি তাদের পরাজয়ের মুহুর্তেও, জেনারেল নিয়াজী রাও ফরমান আলী নিশ্চয়ই এমন চিন্তা উপভোগ করেছিল যে তারা বাংলাদেশকে তার স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ভারী মূল্য দিতে বাধ্য করেছে এটা ভাবতে নিশ্চয়ই তাদেরকে কম আনন্দ দেয়নি যে বাংলাদেশ তার এসসম্ত শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবিদের অবদান ছাড়া অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়বে
 
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নতুন প্রশাসনের তার কাজে মনোনিবেশ করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশী সময় লেগেছে তদন্তকারীরা আশরাফুজ্জামান খানের বাসায় আসার সময়ের মধ্যেই সে পালিয়ে যায় যাই হোক, তাড়াহুড়ায় সে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ফেলে রেখে যায় তদন্তকারীরা তার ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজতে গিয়ে তার বাসা থেকে ধাঁধার অংশটি উদ্ধার করতে সমর্থ হয় তারা আশরাফুজ্জামান খানের ডায়েরী খুঁজে পেয়েছিলসেখানে ছিল তার নিজের হাতে লেখা বুদ্ধিজীবিদের সেই কুখ্যাত তালিকা এটা ছিল সত্যিই একটি বিভীষিকাময় প্রাপ্তি যা মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল আশরাফুজ্জামান খান ছিল একজন ফেরারী আসামী সন্দেহভাজনদের ছবি সকল বাংলাদেশী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল আসামীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য জনগণকে অনুরোধ করা হয়েছিল কিন্তু এসমস্তকিছুই অনেক দেরীতে হয়েছে আশরাফুজ্জামান তাকে গ্রেফতারের জন্য খোঁজ চলাকালে শুধুমাত্র তার বাসা থেকেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি, দেশ থেকেও পালিয়ে যেতে পেরেছিল
বর্তমানে আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্কের সর্বত্র ব্যস্তজীবন অতিবাহিত করছে সে শহরের ইসলামিক আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেআশরাফুজ্জামান খান বর্তমানে উত্তর আমেরিকার ইসলামিক সংস্থার সভাপতি আমার মনে পড়েছে তার ভয়ংকর অতীতের একটি নতুন ঘটনা যখন আমি Washington Post (November 1, 1999) এর একটি সাম্প্রতিক সংস্করণ পড়ছিলাম এখানে মিশরের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে আশরাফুজ্জামান খানের একটি বিবৃতি ছিল আশরাফুজ্জামান খানের উক্তিতে, মাঝে মাঝে আমরা বুঝি যে আমরা অসহায়…….আরেকজন মানুষ তার পিতামাতাকে হারাল কেউ কিছুই জানেনা কিন্তু আমাদেরকে আমাদের আল্লাহ্ উপর বিশ্বাস রাখতে হবে এই উক্তি সেই মানুষের কাছ থেকে আসছিল যার কুখ্যাত তালিকা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের সেই হতভাগ্য সপ্তাহে বহু অগণিত শিশুদেরকে পিতৃহারা করেছিল কি দুর্ভাগ্য, এই ষড়যন্ত্রকারী ১৯৭১ সালে বাঙালী বুদ্ধিজীবি হত্যায় দক্ষ ছিল, বর্তমানে একজন পরিপূর্ণ মানবতাবাদী, এতগুলো বছর পরও! কিন্তু, সে কি মানবতাবাদী? না সে ভেড়ার চামড়ায় একটি নেকড়ে মাত্র সে এটাই!
আমরা বাংলাদেশীরা সম্ভবতঃ নিজস্ব যোগ্যতায় স্বকীয়ভাবে বিবর্জিত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জেনারলে নি্য়াজী রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং বর্তমানে শেখ হাসিনাকে মনে হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট নিহত তাঁর আত্মীয়দের হত্যাকারীদের বিচারে বেশী আগ্রহী ১৯৭১ সালের হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে কারো আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা আমার কাছে বাংলাদেশের আইনের সবচেয়ে বড় পরিহাস এটাকেই মনে হয়
অবশ্য আশরাফুজ্জামান খানকে তার অপরাধমূলক অতীতকে তেমনভাবে ভুলতে দেয়া হয়নি কয়েক বছর আগে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির আশরাফুজ্জামান খানের অস্তিত্ব প্রকাশ করেন, বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সে কোন খারাপ কাজ করেছে-একথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাসম্বলিত বই একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায় এর সংস্করণগুলোতে আশরাফুজ্জামান খানের ছবি কুখ্যাত ডায়েরীর পাতা শোভা পেয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল রাজ্যে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির শাখা রয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এর প্রায় সব সদস্য খুবই তৎপর ছিলেনতারা এমনকি গোলাম আযম তার সাঙ্গদের বিচারের জন্য গঠিত ঐতিহাসিক জনতার আদালতে বিচারকাজে সহায়তা করার জন্য আইনজীবিও প্রেরণ করেছিলকখন তারা আশরাফুজ্জামান খানের পেছনে ছুটবে? একজন যুদ্ধাপরাধীকে আদালতে জবাবদিহিতায় বাধ্য করা যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশী কঠিন হওয়ার কথা নয় মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে যে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
 
-ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে লিখেছেন জামাল হোসেন



Genocide’71 – an account of the killers and collaboratorsঢাকায় প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৮৯ আশরাফুজ্জামান খান ( যে বর্তমানে নিউইয়র্কে এবং কুইনস শাখা, ICNA এর সভাপতি)এর অংশ পাওয়া যায়ঃ
একইভাবে সৌদি আরব কিছু সংখ্যক শীর্ষস্থানীয় আল-বদরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে আসছিল এখানে আমরা আল-বদরের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম আশরাফুজ্জামান খানের উদাহরণ দিতে চাই আশরাফুজ্জামান খান ছিল আল-বদর বাহিনীর সরাসরি ঘাতকদের প্রধানদের মধ্যে অন্যতম এটা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সে নিজের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন শিক্ষককে মিরপুরের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে জনৈক মফিজুদ্দিন, যে আশরাফুজ্জামানের এসমস্ত অসহায় শিকারদের বহনকারী গাড়ী চালাচ্ছিল, সে আশরাফুজ্জামানকে বুদ্ধিজীবি হত্যার প্রধান ঘাতক হিসেবে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে
 
মুক্তিযুদ্ধের পর আশরাফুজ্জামানের ব্যক্তিগত ডায়েরী তার ৩৫০ নাখালপাড়াস্থ বাসা যেখানে সে থাকত, সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ডায়েরীর দুইটি পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯জন শিক্ষকের নাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাদের বাসার ঠিকানাসহ দেয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার মুহাম্মদ মরতুজার নামও এই ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই ২০ জন ব্যক্তির মধ্যে ১৪ই ডিসেম্বর জন নিখোঁজ হনঃ মুনির চৌধুরী (বাংলা), ডঃ আবুল খায়ের (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দীন আহমেদ (ইতিহাস), রাশেদুল হাসান (ইংরেজী), ডঃ ফয়জুল মহি (আই..আর), ডঃ মুনাজা (মেডিকেল অফিসার)
মফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে, আশরাফুজ্জামান এসব মানুষদের তার নিজ হাতে গুলি করে মফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তির কারণে এই সমস্ত হতভাগ্য শিক্ষকদের ছিন্নভিন্ন শরীর রায়েরবাজারের জলাভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ি গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় ডায়েরীতে অন্যান্য নামগুলোর মধ্যে এগুলোও ছিলঃ ডঃ ওয়াকিল আহমেদ (বাংলা), ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম (বাংলা), ডঃ লতিফ (আই..আর), ডঃ মনিরুজ্জামান (ভূগোল), কে.এম.সাদউদ্দীন (সমাজবিজ্ঞান), .এম.এম. শহীদুল্লাহ্‌ (গণিত), ডঃ সিরাজুল ইসলাম (ইসলামের ইতিহাস), ডঃ আখতার আহমেদ (শিক্ষা), জহিরুল হক (মনোবিজ্ঞান), আহসানুল হক (ইংরেজী), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী) এবং কবির চৌধুরী
ডায়েরীর আরেকটি পাতায় পাকবাহিনীর দোসর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল এছাড়াও বুদ্ধিজীবি হত্যার অপারেশনের প্রধান ব্যক্তি চৌধুরী মঈনউদ্দীন, কেন্দ্রীয় আল-বদর শাখার একজন সদস্য শওকত ইমরান এবং ঢাকার বদর বাহিনীর প্রধানের নামও ডায়েরীতে ছিল    
খুন হওয়া বুদ্ধিজীবিদের নাম ছাড়া ডায়েরীতে অন্যান্য বাঙ্গালীদের নাম-ঠিকানা ছিল তাঁরা সবাই আল-বদরের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন একটি ছোট্ট কাগজের টুকরোতে পাকিস্তান পাট-বোর্ডের অর্থ সদস্য আবদুল খালেকের নাম, তাঁর বাবার নাম, তাঁর ঢাকার ঠিকানাসহ তার বর্তমান ঠিকানা লেখা ছিল ১৯৭১ সালের ৯ই ডিসেম্বর, আল-বদর বাহিনী আবদুল খালেককে তাঁর অফিস থেকে ধরে নিয়ে যায় তারা ১০,০০০টাকা মুক্তিপণ দাবী করে এরপর আল-বদর বাহিনী আবদুল খালেকের কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে তাঁর বাড়ীতে যায়, যে চিঠিতে তিনি অপহরণকারীদের টাকা দিয়ে দেয়ার জন্য বলেছিলেন আবদুল খালেকের স্ত্রী সময়ে ৪৫০ টাকার বেশী দিতে অপারগ ছিলেন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে বাকি টাকা তিনি তাদের পরে দিয়ে দেবেন এবং তিনি তাদের অনুরোধ করলেন যেন তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়া হয় কিন্তু আবদুল খালেক কখনও ফিরে আসেননি

আশরাফুজ্জামান কিছু সাংবাদিক হত্যার সাথেও জড়িত ছিলেন পূর্বদেশ পত্রিকার শিফট-ইন-চার্জ সাহিত্য সম্পাদক .এন.এম. গোলাম মোস্তফাকে আশরাফুজ্জামান অপহরণ করেছিল
আশরাফুজ্জামান খান ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিল স্বাধীনতার পর সে পাকিস্তান যায় বর্তমানে সে রেডিও পাকিস্তানে কর্মরত আছে
সর্বশেষঃ এই বই প্রকাশের পর থেকে আশরাফুজ্জামান খান নিউ ইয়র্কে চলে যায় এবং বর্তমানে সে উত্তর আমেরিকার ইসলামিক সংস্থা (ICNA)এর কুইনস শাখার সভাপতি     
      
  

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের নিহত বুদ্ধিজীবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী
ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অত্যন্ত সন্মানিত একজন শিক্ষক ডঃ জি. সি. দেব এর পালিত কন্যা বেগম রোকেয়া সুলতানা দ্বারা উদ্বৃত একটি সত্যি ঘটনা,ডঃ জি.সি. দেব ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন ২৫শে মার্চ বাঙ্গালীদের উপর সামরিক জান্তা দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার পরদিন, ছাড়া পাওয়া বেগম রোকেয়া সুলতানা ২৬শে মার্চ ডঃ দেব এর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যিনি কিছুক্ষণ আগে নিহত হয়েছেন তাঁর একমাত্র শিশুসন্তান রাবেয়া তখন তাঁর কোলে ছিল রোকেয়ার স্বামীর নিথর দেহও সেখানে পড়ে ছিল
সন্তানকে কোলে নিয়ে রোকেয়া বুঝতে পারছিলেননা যে কি করা উচিৎ ভয় এবং প্রচন্ড আঘাতে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন সেই কালো, অন্ধকার রাত্রির অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে এটি ছিল একটি, যে রাত বাঙ্গালীদের একটি যোদ্ধার জাতিতে পরিণত করেছিল মৃত্যুর সংজ্ঞা রোকেয়ার কাছে জানা ছিলনা কিন্তু তিনি ২৫শে মার্চের সেই চরম কালো রাত্রির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ২৬শে মার্চের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল যা শুধুমাত্র একজনের শেষমুহুর্তগুলোর সাথেই তুলনাযোগ্য ২৬শে মার্চ সকালে ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব এলোপাথারি গুলির কারণে রোকেয়ার চোখের সামনেই পড়ে যান মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তিনি তাঁর শিশুসুলভ সারল্যতায় পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে বাবা (পুত্রতুল্য সম্বোধন) বলে সম্বোধন করছিলেন তিনি তাঁর বাসায় তাদের আচমকা অভিযানের কারণ জানতে চেয়েছিলেনএই নিষ্ঠুরতা ঘটানোর পেছনে রোকেয়া কোন প্রাসঙ্গিক কারণ খুঁজে পাননি।
মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় ড. দেব শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেননা। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়ে ব্যাথা নিয়ে ফিরে আসেন। মার্চে তিনি দাঁতের ব্যাথায় ভুগছিলেন।  ব্যাথাটি এমনকি তাঁর কন্ঠনালীতেও ছড়িয়ে পড়ে। ড. দেব সাধারণত রাজনীতি বিষয়ক কোন আলোচনায় অংশ নিতেন না, কিন্তু মার্চের অসহযোগ আন্দোলন মাঝে মাঝে তাঁকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলত। বাংলা শব্দ মুক্তি তাঁর কাছে বিশেষ অর্থ বহন করত। ২৩শে মার্চ যখন প্রাক্তন ছাত্রনেতা মরহুম আবদুল কুদ্দুস মাখন ড. দেব এর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, ড. দেব তাঁকে (মাখনকে) স্বাধীন বাংলার পতাকা কেনার জন্য স্বেচ্ছায় টাকা দিয়েছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, এবার দেশের জন্য অর্থবহ কিছু হবে। 
২৫শে মার্চ তিনি প্রতিদিনের মত সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বের হন। রাত ৮টায় বাসায় ফেরার পর তিনি তাঁর রিডিং রুমে প্রবেশ করেন। রোকেয়া তাঁকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলেছিলেন কারণ তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেননা। তাঁর (রোকেয়া) স্বামী মরহুম মোঃ আলী ছিলেন একজন ব্যাংকার। তিনি তাঁর বি.এড. পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সারাদিনের কাজের পর তাঁর স্বামী এবং ড.দেব ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। 
তখন রাত ১১টা। ক্রমাগত গুলির আওয়াজ রোকেয়াকে চমকে দিল। ভয় পেয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে ডাকলেন। সেসময় তাঁরা জগন্নাথ হল এলাকায় বসবাস করতেন। রোকেয়াদের কক্ষ ছিল এক কোণায় এবং ড.দেবের কক্ষ ছিল বাড়ীর মাঝখানে। মোঃ আলী গুলির শব্দে জেগে উঠলেন। তাঁদের কাছে সেটাকে ভূমিকম্পের মত মনে হল। বুলেট ঝড়ের মত বাড়ীটিকে আঘাত করছিল। পুরো বাড়ী কাঁপছিল। মোঃ আলী এবং রোকেয়া তাঁদের শিশুসন্তানসহ মাঝখানের কক্ষে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এলেন। ড.দেব ভয় এবং আতংকে থরথর করে কাঁপছিলেন। সন্তানকে মোঃ আলীর হাতে দিয়ে রোকেয়া ড.দেবকে জড়িয়ে ধরলেন। গভীর রাতে এত বেশী গোলাগুলি হচ্ছিল যে, তাঁদেরকে বাড়ীর একটি ছোট্ট কক্ষে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। পাকিস্তানী সেনারা লাউডস্পীকারের মাধ্যমে তাঁদেরকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিচ্ছিল। তারা ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করছিল। ভোর নাগাদ গুলির শব্দ প্রায় থেমে এসেছিল। সারারাত জেগে থেকে ড.দেব খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি প্রায় ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। চরম ক্লান্তি ও পরিশ্রান্তি সত্ত্বেও তিনি রোকেয়াকে বললেন, মা, এখন প্রার্থনার সময়। তুমি কি আমাকে তার জন্য একটা জায়গা দেবে? গুলির শব্দ তখন আর ছিলনা। রোকেয়া মাঝখানের ঘরটি পরিষ্কার করে দিলেন ড.দেবের প্রার্থনার জন্য। পাকিস্তানীদের লাগামহীন উন্মত্যতার কারণে পুরো বাড়ীটি এমনভাবে অগোছালো হয়ে পড়েছিল যে, এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দেয়ালে অসংখ্য গর্ত হয়েছিল। দেয়ালের পলেস্তারা খসে আসছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ীটি যেকোন মূহুর্তে ভেঙ্গে পড়বে। 
মোঃ আলী সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় পড়েছিলেন। ফ্লাস্কে রাখা গরম পানি দিয়ে কোনরকমে এক কাপ চা বানিয়ে রোকেয়া ড.দেবের কক্ষে নিয়ে গেলেন। তিনি চা পান করার পর স্বস্তি অনুভব করলেন।
পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত উন্মত্ততার বর্ণনা দেয়ার সময় রোকেয়াকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সেটি তাঁর জীবন বাংলাদেশীদের প্রত্যেকের জীবনে একটি অভিশপ্ত মূহুর্ত ছিল। তিনি বললেন, তাঁর সন্তানও দেখেছে কিভাবে তাঁর পিতামহ নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন। দখলদার শক্তিরা ড.দেবকে শিশুটির সামনে হত্যা করে। নির্মম সেই হত্যাকান্ডের স্মৃতি এখনও আমার কন্যার মনে জ্বলজ্বল করছে- এটি মনে করে তিনি (রোকেয়া) ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। সেটা ছিল ২৬শে মার্চের সেই অভিশপ্ত সকাল। পুরো জগন্নাথ হল এলাকা সৈন্যতে পরিপূর্ণ ছিল। আগের রাতে হত্যা করা লাশগুলো ডরমিটোরী বিল্ডিংয়ের সামনে পড়েছিল। নির্যাতিত মহিলাদের আর্তনাদের আওয়াজ আশেপাশের এলাকা থেকেও শোনা যাচ্ছিল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় আমরা সবাই বাড়ীর মাঝখানের কক্ষে জড়ো হলাম। কিছুক্ষণ পর সদর দরজায় কড়াঘাতের শব্দ এল। কেউ চিৎকার করে বলছিল, মালাউন কি বাচ্চা, দারওয়াজা খোল দো। সেটা আদেশ ছিলনা। সেটাকে বর্বর ব্যক্তির গর্জন বলে অনুভূত হচ্ছিল। ভয় পেয়ে ড.দেব সন্ত্রস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রোকেয়া তাঁকে জোর করে বসিয়ে দিলেন। দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজ ক্রমাগত বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছিল তারা তাদের বুটজুতা দিয়ে দরজায় লাথি মারছিল। দরজাটি প্রায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
শিশুটিকে ড.দেবের কোলে রেখে রোকেয়ার স্বামী দরজার দিকে হেঁটে গেলেন। দরজাটির নির্মম আঘাতের সামনে স্থির থাকার উপায় ছিলনা। তিনি দরজার কাছে পৌঁছামাত্রই সেটি ভীতসন্ত্রস্ত বৃদ্ধের উপর ধ্বসে পড়ল। ড.দেব কোনরকমে ধ্বসে পড়া দরজা থেকে বের হয়ে আসতে সমর্থ হলেন। সাথে সাথে এক সৈনিক রাইফেল দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করল। দূর থেকে একটি গুলি তাঁর বুকে আঘাত করল। তিনি সেখান থেকে সরে আসতে চাইলেন। কয়েক কদম পরেই তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা মাঝের কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেখানে মাত্র তিনজন ড.দেব, শিশুটি এবং রোকেয়া ছিলেন। ড.দেব এতই স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি আক্রমণকারীদের শান্তভাবে তোমরা এখানে কি চাও বাবা? জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেননা। এটা ছিল তাঁর শেষ উক্তি। এর জবাবে তারা তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করল। দুটি বুলেট তাঁর মাথায় ঠিক একটি কানের কাছে এবং অন্য গুলিগুলো তাঁর বুকে আঘাত করল। তারা রোকেয়াকেও নির্মমভাবে প্রহার করছিল। তারা বারবার ঘরের কোথায় রাইফেলগুলো আছে জানতে চাচ্ছিল। তারা বারবার ড.দেবের মৃতদেহে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করছিল। সেটা ছিল একটি ভয়ংকর দৃশ্য। রোকেয়া মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন যে, তিনি শিশুটিকে তাঁর আরো কাছে টেনে আল্লাহ্‌ বলে চিৎকার করছিলেন। তিনি এখনও জানেননা যে ঐ চিৎকারের কারণে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন কিনা। পাকিস্তানীরা ড.দেব এবং তাঁর স্বামী মো.আলীর মৃতদেহ নিয়ে গেল এবং জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে শত শত লাশের মাঝে রাখল। এই নির্মম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ও দার্শনিকের জীবনাবসান ঘটল।



ডঃ জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজী বিভাগ)
আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবি জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতার স্মৃতি, যিনি পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিহত হন মেঘনা গুহঠাকুরতা
যখন আমি ফিরে তাকাই বাগানের চারাগাছ, শীতকালীন ডালিয়া ফুলগুলোর দিকে, আমি আমার শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাই। দক্ষিণ এশিয়ার শুষ্ক শীতের সকালের বুনো এই রঙগুলোর মাঝে আমি বাবাকে গাছের মরা প্রশাখাকে ছেঁটে ফেলতে, কন্টকময় গোলাপের গুচ্ছ থেকে মরা পাতা তুলে ফেলতে এবং রডোডেনড্রন ফুলের পাতা তুলতে দেখতে পাই। বাগানটি ছিল আমার বাবার প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্র। তিনি নিজেকে গর্বভরে প্রধান বাগান সংরক্ষণকারী ও তাঁর রাজ্যের রাজা হিসেবে দাবী করতেন, এবং কেউ কোন অবস্থাতেই সেখানে অবস্থিত যেসব ফুল বা চারাগাছের নাম জানত না  এবং যাদের কাছে দেয়ালের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রকার জেসমিন ফুলের নিগূঢ় সুগন্ধের কারণে অস্পৃশ্য অথবা সূর্যাস্তে পরিবর্তনশীল অসাধারণ বর্ণচ্ছটার সাথে সংবেদনহীন ছিল, তারা বাগানটিতে প্রবেশে সাহস করতো না। আমার প্রথম দিককার স্মৃতিতে আমি দেখতাম একদল উদ্বিগ্ন কিন্তু অধীর আগ্রহী ছাত্ররা দলবেঁধে আমাদের বাড়ীতে আসত এবং সতর্ক পায়ে হেঁটে হেঁটে আমার বাবার পদচিহ্নের কাছাকাছি তাঁর রাজ্যের ভেতরে আনাগোনা করত। তারা ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ছিল যাদের Keats and Wordsworth এর কবিতায় সমস্যা হচ্ছিল, বাবার দরজার সামনে পৌঁছাল, তারা আরো বেশী জানার ব্যাপারে তৃষ্ণার্ত ছিল। কিন্তু তারা কি আসলেই জানত তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে!!! প্রথমেই তাদেরকে উজ্জ্বল সূর্যালোকের মাঝে বিভিন্ন রকমের সবুজকে আলাদা করার ক্ষমতা দেখাতে হয়েছিল। তারপর আশেপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চারা পরিচর্যা করার সময় পৃথিবীর আচরণ এবং বাড়ন্ত চারাগাছের কিভাবে পানির প্রয়োজন সেসম্পর্কে তাদের গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। তারপর এটা অবশ্য পালনীয় ছিল যে উজ্জ্বল বেগুণী, হলুদ, গোলাপী এবং লাল রঙগুলোকে সংগঠিত করা যাতে করে এগুলো ভয়াবহভাবে সাংঘর্ষিক না হয় বরং চারিদিকে আনন্দদায়ক সুর প্রবাহিত করে। 
এবং সাহিত্যের, ইংরেজীর, বাংলার প্রতিটি পাতার শিক্ষায় অথবা জীবনে যা কিছুই্ ছাত্রদের জীবনে আসুক, ছাত্ররা আচমকাই তাদের শরীরে রবীন্দ্রনাথ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ  এবং ইয়েটসের কবিতার আমার বাবার আবৃত্তির শব্দ কম্পন সৃষ্টি করত। 
বাগান করা নিয়ে আমার বাবার শখ শুধু সর্বজন বিদিতই ছিলনা, তা ছিল বিখ্যাত। একবার চারিদিকে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, কলেজের পরীক্ষার জন্য ইংরেজীর প্রশ্ন করার জন্য তাঁকে বলা হয়েছিল।  এসব তরুণ পরীক্ষার্থীরা কি ধরণের রচনা পরীক্ষায় আসবে সে ব্যাপারে সাজেশন পাওয়ার জন্য বাবার অনেক ছাত্রদের খাওয়াদাওয়া করাতো। বাবার ছাত্ররা তাদের শ্রমের কারণে ভালভাবে আপ্যায়িত হয়ে একটি সচরাচর কথা বলত, এটা(রচনার বিষয়) অবশ্যই বাগান করার শখ হতে হবে!  উল্লাসিত পরীক্ষার্থীরা তাদের মধ্যরাতের তেলের কুপিতে গিয়ে বাগান করার পদ্ধতির সকল দুঃসাধ্য ব্যাখ্যাগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কিন্তু হায় তাদের বিস্ময়ের সীমা থাকল না যখন তারা পরদিন সকালে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে তাদের মুখের সামনে শখ হিসে মাছ ধরা সম্বন্ধে রচনা লিখতে বলা হল। বোকা বনে যাওয়া ছাত্ররা যখন আমার বাবাকে একটি ভুল রচনার জন্য রাক্ষসের মত রাতের খাওয়ার কাহিনীটি বলল, তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন কিন্তু তাঁর চোখ উজ্জ্বল বর্ণের ডালিয়া ফুলের মত সংগোপনে মিটমিট করছিল। 
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের হতভাগ্য রাতের মাত্র নয়মাস আগে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেয়া নতুন আবাসে স্থানান্তরিত হই। বাড়ীটি ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ঠিক বিপরীতে এবং ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হল, যার প্রভোস্ট নিযুক্ত করা হয় আমার বাবাকে - তার পূর্ব দিকের রাস্তার ধারেআমার বাবা সবসময় চাইতেন নিচের তালার বাড়ী যাতে করে তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলো করতে পারেন। আমাদের স্থানান্তরিত হওয়া ফ্ল্যাটটির পেছনের দিকটা ছিল ক্রমাগত জমে ওঠা ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ যা বাগানে রুপান্তরিত হওয়ার আগে অনেক কাজ করার ছিল। কিন্তু এটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ যা আমার বাবা গ্রহণ করেছিলেন ঐ স্থানে প্রবেশ করার পর থেকেই। ১৯৭০ সালের শীতের ভেতরেই অবাঞ্চিত গাছড়া পরিষ্কার করা হল, পুরো মাটি খোঁড়া হল এবং বালু ও কাদামাটির মিশ্রণ তার ওপর দেয়া হল যা একটি খাঁটি সবুজের আঙ্গিনার জন্ম দিতে পারে। বিছানাগুলোও বিস্কিট, লেবু, গোলাপী ও গাঢ় খয়েরী প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের  রৌদ্রজ্বল গাঁদাফুল ও ডালিয়া ফুলের জন্য প্রস্তুত ছিল। এতে করে অনেক পথচারী থমকে দাঁড়াতো এবং দেয়ালের এই দৃশ্যের দিকে তাকাতো এবং আমার বাবার মুখমন্ডল একটা উজ্জ্বল ডালিয়া ফুলের মত গর্ব সহকারে আলোকরশ্মির মত উজ্জ্বল হতো।
কিন্তু হায় সেটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের হতভাগ্য সেই রাত যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্যরা তাদের অপারেশন সার্চলাইট মিশনে এই অমূল্য বাগানকে পদদলিত করল এবং মূল দরজা অতিক্রম করল অধ্যাপক -এর খোঁজে। এটা ছিল সেই ভালোবাসার আ্ঙ্গিনা যেখানে বাড়ীর সন্মুখদিকে তাঁকে বন্দুকের মুখোমুখি করা হয়েছিল এবং তাঁর নাম ও ধর্ম বলার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমার বাবা উত্তর দেয়ার সাথে সাথেই গুলি করার আদেশ দেয়া হল। বাবা মুখ ঘুরিয়ে ফেলার সময় ঘাড়ে আঘাত পেলেন এবং একবার তাঁর কোমড়ে যা তাঁকে কোমড়ের নিচের অংশকে অবশ করে ফেলেছিল। তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সৈন্যরা দল নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ক্যাম্পাসের অন্যান্য জায়গায় তাদের দায়িত্ব পালন করতে লাগল যেখানে নরকের পরিবেশের উদ্ভব হয়েছিল। তিনি চেতনা ফিরে পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি আমাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। আমরা বুঝতে পারলাম কি ঘটেছিল, যতক্ষণে আমরা ধরতে পারলাম যে তাঁকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবেশীরা তাঁকে বাড়ীতে আনার জন্য আমাদের সাহায্য করল, কিন্তু দুই রাত এবং দুই দিন আমরা তাঁকে কোন চিকিৎসা দিতে পারলামনা। সেনাবাহিনীর গাড়ী টহলে ছিল, এবং ডানে-বামে গুলিবর্ষণ হচ্ছিল। এরই মধ্যে সৈন্যদের একটি দল এসে মৃতদেহ সংগ্রহ করে জগন্নাথ হলে খোঁড়া গণকবরে সমাহিত করার জন্য নিয়ে গেল। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং তাঁর পরিবারের তিন ছেলে সবাই সেদিন রাতে গুলিতে নিহত হন এবং তারা তাঁদের দেহগুলো আমাদের তৃতীয় তলায় বসবাসকারী পরিবারের কাছ থেকে টেনে নিয়ে গেল। তারা আমার বাবার শরীর গুণতে ভুলে গেল। আমরা ২৭ তারিখ ভোরেই কার্ফিউ ভাঙার পর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলামতিনি দুর্বল ছিলেন কিন্তু তাঁর জ্ঞান ছিল। কিন্তু ডাক্তাররা বললেন তাঁর দিন ফুরিয়ে আসছে। আঘাতটা খুবই মারাত্মক ছিল। তিনি ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমার মা তাঁর একাত্তরের স্মৃতি তে আমার বাবার সাথে একটি কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করছিলেন যখন শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে জনতার অসহযোগ আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। অনেকেই আমার বাবাকে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি একজন ছাত্র ক্যাম্পাসে থাকা পর্যন্তও ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে পারতেননা। বরং বিষাদপূর্ণভাবে বাগানের একটি ফুলের টবের দিকে নির্দেশ করে আমার মা-কে বললেন। ফুলের টবটিতে তিন আকারের তিনটি বিস্কিট রঙের ডালিয়া ফুল ছিল। একটি ছিল বড়, একটি দ্বিতীয় মধ্যম এবং শেষেরটি ছিল ছোট। তিনি আমার মা-কে বললেন, দেখ বাসন্তী, এই তিনটি ডালিয়া আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। আমি হলাম সবার বড়, এটা সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রায় মরে যাচ্ছে মাঝেরটা তুমি এবং তৃতীয়টি দোলা (আমি)যখন আমি চলে যাব এই দুটি তখনও জীবিত থাকবে। মা তাকে সাথে সাথে থামিয়ে দিলেন এবং এসব চিন্তা বাদ দিতে বললেন। কিন্তু ২৫তারিখ সকালে অবশ্যম্ভাবীভাবে বড় ডালিয়া ফুলটি এতটাই বিবর্ণ হয়ে গেল যে আমার মা তার কান্ড কেটে ফেললেন, বাকী দুটোকে তাদের মত ফেলে রাখলেন।
আমরা আমাদের দুর্বলতম মুহুর্তে এসব ঘটনা স্মরণ করি, যখন আমরা জানিনা যে কিভাবে আমাদের আবেগের সাথে সমঝোতা করতে হবে। আমার কাছে, বাকি দুটো ডালিয়া ফুল আমার বাবার পৃথিবী ও মানবতার প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে প্রদর্শন করে, যা বুলেট বা ঘৃণা দিয়ে হত্যা করা যায়না। তিনি আমাদের এই ভালোবাসা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ভয় ও ঘৃণাকে জয় করা ছাড়া আর কিছুই চাননি। এ কারণেই যখনই এবং যেখানেই আমি ডালিয়া ফুল ফুটতে দেখি, আমার হৃদয় বিকশিত হয়ে পড়ে আর হাসিতে স্বীকারোক্তি দেয় ..... হে বাবা!!!    

অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ
মুনীর চৌধুরী ছিলেন আমাদের দেশের অন্যতম তুখোড় ব্যক্তিত্ব।  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর ও খুনীদের দ্বারা ১৯২৫ সালের ২৭শে নভেম্বর জন্ম নেয়া এই ব্যক্তির বিখ্যাত জীবন নির্মমভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত আগ্রহী জাতীয়তাবাদী কিন্তু উশৃঙ্খল ছিলেননা। ছাত্রজীবনে তিনি একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট ছিলেন, দলের নিয়মিত সদস্য এবং কার্ডধারী, কিন্তু তিনি সেই সম্পর্ক স্বেচ্ছায় ছিন্ন করেন বহু বছর আগে। তিনি একজন বিদ্যান, একজন অধ্যাপক ও একজন লেখকের জীবন বেছে নেন এবং তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেন। আলিগড়, ঢাকা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এসে তিনি প্রথমে ইংরেজী সাহিত্যের একজন ভাল শিক্ষক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তা সত্ত্বেও তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবলভাবে নিমগ্ন ছিলেন এবং তিনি ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে কারাবরণ করেন যেখানে অন্যান্যদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর কারাসঙ্গী ছিলেন। জেলে অবস্থানকালে তিনি গভীর মনোযোগের সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন, জেলের অভ্যন্তরে থেকে তিনি বাংলায় সন্মান (এম.এ) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। কারাবরণ থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় শিক্ষকতা শুরু করেন, পরে তিনি ঐ বিভাগের চেয়ারম্যান ও কলা অনুষদের ডীন নিযুক্ত হন, যে পদে তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আসীন ছিলেন। মীর মোশারফ হোসেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারে যখন তিনি অননুকরণীয়ভাবে পাঠদান করতেন, অন্যান্য বিভাগ থেকে ছাত্ররা দলবেঁধে তাঁর ক্লাসে চলে আসত। আজ তাঁকে অসাধারণ শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় যিনি মহান সাহিত্যকর্মের প্রতি তাঁর ছাত্রদের ভেতর উৎসাহ সৃষ্টি করতেন।
মুনীর চৌধুরী সত্যিকারের একটি সৃজনশীল মনের অধিকারী ছিলেন। তিনি অনেক বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, এবং তিনি বহু ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণের ছাপ রেখে গেছেন। তিনি বাংলা টাইপরাইটারের জন্য একটি কি-বোর্ড এর নকশা  করেন যা পূর্ববর্তীগুলোর চেয়ে অনেক উচ্চমানের ছিল। জার্মান এক কোম্পানী দ্বারা বাণিজ্যিকভাবে স্বত্ত্বাধিকার প্রাপ্ত এই কি-বোর্ড মুনির-অপটিমা টাইপরাইটার নামে পরিচিত ছিল। তিনি নাটক, ছোটগল্প, সাহিত্য সমালোচনা, বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধ লেখা এবং রম্য ছবি আঁকার পাশাপাশি বহু ইংরেজী নাটককে বাংলায় রূপান্তর করেন। যাই হোক, তাঁর শক্তিশালী দিক ছিল নাটক এবং তাঁকে যৌক্তিকভাবে বাংলাদেশের আধুনিক নাটকের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শৈশবকাল থেকে তিনি নাটকবিশ্ব সম্বন্ধে প্রবলভাবে আকর্ষিত ছিলেন। স্নাতকের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থাতেই তাঁর একক অভিনীত নাটক রাজার জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে প্রদর্শিত হয়। তিনি অত্যন্ত আগ্রহভরে বিশ্বের সেরা পুরোনো ও আধুনিক, বিখ্যাত ও আদর্শ নাটকগুলো পড়েছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, রাশিয়া এবং জাপানসহ বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন, তিনি স্থানীয় থিয়েটার হল এবং অপেরা হাউসগুলোতে ভ্রমণ করে কিছু প্রদর্শনী দেখেছিলেন এবং সমসাময়িক স্থানীয় নাট্যকারদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।  
মুনীর চৌধুরীর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হল কবর যা ১৯৫২ সালের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা হয়েছে। একদল রাজনৈতিক বন্দীদের দ্বারা জেলের অভ্যন্তরে অস্থায়ী মঞ্চে প্রথমবার মঞ্চস্থ হওয়া কবর সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী কয়েকশবার প্রদর্শিত হয়েছে এবং এই ধারা কখনও হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়নি। তাঁর অন্যান্য নাটকের মধ্যে আছে তিন অভিনেতার একটি ঐতিহাসিক নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর, তিন অভিনেতার একটি সামাজিক নাটক চিঠি, গ্লাসওয়ার্দির সিলভার বক্স এর সুন্দর রূপান্তর রূপার কৌটা, বার্নাড শ এর ইউ নেভার ক্যান টেল এর অসাধারণ রূপান্তর কেউ কিছু বলতে পারেনা এবং শেক্সপিয়ারের taming of the shrew এর অসাধারণ অনুবাদ মুখরা রমণী বশীকরণ ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় এই সব নাটকই সফলভাবে মঞ্চস্থ  সম্প্রচারিত বা টেলিভশনে প্রচারিত হয়েছে। 
তাঁর নাটকগুলো মঞ্চশিল্প সম্বন্ধে তাঁর দক্ষ জ্ঞানকে পর্যাপ্তভাবে প্রদর্শন করে। এগুলো দক্ষভাবে তৈরী করা হয়েছে, সংলাপগুলো প্রবল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন এবং এগুলোর বিষয়বস্তু বৃহৎ স্বাধীন মানবতাবাদ দ্বারা চরিত্রায়ণ করা হয়েছেনাটকগুলো রসবোধ জন্ম দেয়, কখনও কখনও তী্ব্রতা বা ব্যাঙ্গ, কখনও অবাস্তব ও উচ্ছলতার জন্ম দেয় এবং প্রায়ই উচ্চ রসবোধ দ্বারা বিনোদিত করে। 
বর্তমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি যদি গণতান্ত্রিক মতবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের সাথে বসবাস করতেন, তিনি আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অমূল্য পরিবর্তন করতে পারতেন, কিন্তু উক্ত ধ্যান-ধারণা বিরোধী অপশক্তিরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নিএটা খুবই দুঃখজনক যে ঐসব স্বেচ্ছাচারী অপশক্তি, ধর্মীয় উগ্রতা ও নিষ্ঠুর অপব্যবহার বাংলাদেশে এখনও আছে, বরঞ্চ এখন তা আরও বেড়ে গেছে। মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করে, চলুন আমরা যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের ঐসব শক্তির হিসাব মেটানোয় পুনঃ উৎসর্গ করিযদি আমরা তা না করি, বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
(কবির চৌধুরী, নিউ এইজ, ১৪ই ডিসেম্বর ২০০৩)

আমরা যেন অধ্যাপক মুনীরকে ভুলে না যাই
২০০৩ সালের এই ১৪ই ডিসেম্বর ছিল আমার কীর্তিমান ভাইয়ের অপহরণের ৩২তম বার্ষিকী। আমার ভাই এবং আমি বাইরের বারান্দা থেকে সেন্ট্রাল রোডের আমাদের পূর্বসূরীর বাড়ী দেখছিলাম, ভারতীয় যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ছিল, বস্তুতপক্ষে রকেট নিক্ষেপ করছিল একটি ঘরে যেখানে তৎকালীন পাক সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তখন সকাল ১১.৪৫ বাজছিল যখন ভোর ৭টায় শুরু হওয়া গোলা ও রকেট নিক্ষেপ হঠাৎ করে থেমে গেল। 
আমার মা নিচের তলার বারান্দার বিপরীত ঘরের ভেতরের ঘর থেকে ডাক দিলেন, এখন যেহেতু আকাশ হামলা কিছুটা শান্ত হয়েছে, তোমাদের দুইজনেরই দ্রুত গোছল সেরে দুপুরের  খাওয়া খেয়ে নেয়া উচিৎ। আমি টেবিল সাজাচ্ছি।  এই সময়ে আমরা দুজনেই নিচে নেমে আসি এবং আমার ভাই তাঁর গোছলের জন্য গেলেন অস্থায়ী গোছলখানায় যেটা ছিল ঘরের ভেতরের অংশে ছয় গুণিতক তিন ফিট কনক্রিট প্ল্যাটফর্মে যেখানে ছিল একটি বালতি, একটি প্লাস্টিক মগ এবং একটি দশ থেকে বার বালতি পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পানির ট্যাংক। 
এই সময়ে আমি আমার ভাইয়ের গোছল করে ফিরে আমার জন্য জায়গা করে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন দেখলাম কাদায় আচ্ছাদিত একটি মাইক্রোবাস আমাদের মূল সদরের সামনে থামল এবং প্রায় তিন-চারজন সামরিক পোশাক পরিহিত তরুন যুবক মাইক্রোবাস থেকে নামল। সকলের আয়ত্বেই রাইফেল ছিলতাদের মধ্যে দুইজন ঘরের ভেতরের অধিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দ্যেশ্যে বড় গেট থেকে সুসংগঠিত লোহা দ্বারা তৈরী ঝুলন্ত তালা ভাঙ্গার জন্য বিকট শব্দ সৃষ্টি করছিলআমি নিচের তলার একটি রুমের জানালা থেকে এসব দৃশ্য দেখছিলাম, যে রুম থেকে সদর দরজা ও পাশের রাস্তাসহ সামনের আঙিনার সবকিছু পরিষ্কার দেখা যেত। 
আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল উপেক্ষা করা, অপেক্ষা করা এবং দেখা এবং আশা করছিলাম যে তারা তাদের চেষ্টা বাদ দেবে এবং চলে যাবে। এমন কিছুই ঘটেনি। তাদেরকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখাচ্ছিল এবং তখন তারা চিৎকারও শুরু করল। এটা দেখে আমি বাইরে বেরিয়ে আসলাম এবং অজ্ঞাত স্থান থেকে উদয় হওয়া এইসব লোকদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলামএছাড়া আমি তাদের উদ্দ্যেশ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম কারণ সমগ্র শহরব্যাপী পাক সেনাদের দ্বারা জারিকৃত কার্ফিউ চলছিলআমি যতই গেটের কাছাকাছি আসছিলাম, বন্ধ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন ব্যক্তির একজন আমাকে গেট খুলে দিতে বলল যার প্রতিউত্তরে আমি বললাম যে আমি তাদের আগমণের কারণ জানতে চাই। তারা তিনজন একইসাথে বলল যে তারা মুনীর স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি তখন সামান্য উদ্বিগ্ন হলাম এবং তাদেরকে বললাম যে তিনি দেখা করতে পারবেননা কারণ তিনি অসুস্থ। এই মুহুর্তে তাদের একজন ক্রোধের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল এবং  সংক্ষিপ্ত স্বরে আমাকে গেট খুলে দিতে বলল আমি তাদেরকে আর বেশীক্ষণ আঙিনায় আসতে বাঁধা দিতে পারলামনা। আমার ভাইয়ের অসুস্থতা এবং তাঁর দেখা করতে অপারগতার ব্যাপারে কিছু বাক্য বিনিময় ও তর্ক-বিতর্কের পর আমি সবশেষে লোকগুলোকে (পরে জানতে পেরেছিলাম তারা রাজাকার ছিল) অপেক্ষা করতে বললাম যতক্ষণ না আমি আমার ভাইকে জানাই। 
আমি ঘরে ঢোকা মাত্র আমি আমার ভাইকে সিঁড়িঘরের মাঝখানের জানালার সামনে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখলাম, তখনও তিনি গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত ছিলেন। আমি কিছু বলার আগেই , তিনি জানতে চাইলেন লোকগুলো তার সাথে দেখা করতে এসেছে কিনা। আমার কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি আমাকে তাদেরকে অপেক্ষা করার জন্য বলতে বললেন। পাঞ্জাবী, লুঙ্গী ও একজোড়া পাদুকা পড়ে কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে আসলেন। যখন তিনি রাজাকারদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তারা তাকে সম্ভাষণ জানাল এবং বলল যে তারা তাঁকে কিছু জিঞ্জাসাবাদের জন্য পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে এসেছে। এই সময় আমার ভাই তাদের কাছ থেকে গ্রেফতারী পরোওয়ানার মাধ্যমে তাদের অধিকার দেখতে চান। রাজাকারদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময়ের পর তারা আমার ভাইকে তাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে জোরও করতে পারলনা কিংবা তাঁর গ্রেফতারের স্বপক্ষে কোন কাগজপত্রও দেখাতে পারলনা। বিষয়গুলো সামনে আসামাত্রই আমার ভাই তাদের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। যখন আমি সকল কর্মকান্ড তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, রাজাকারদের একজন হঠাৎ তড়িত গতিতে আমার ভাইয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর পেছনে অস্ত্র তাক করে তাঁকে সামনে এগুতে নির্দেশ দিল। ঘটনাবলীর আচমকা মোড়ে আমি সম্পূর্ণভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমার ভাইয়ের পেছনে পেছনে অনুসরণ করলাম বাসের দরজা পর্যন্ত। এবং তখন তিনি বাসে উঠার সময় তিনি আমার দিকে ঘুরলেন আর বললেন, রুশদী (আমার পরিবার আমাকে এই নামে সম্বোধন করত), আমি বরং যাই।
পরিশিষ্ট
সেই ভয়ংকর ঘটনার পর ৩২ বছর পার হয়ে গেছে, আমি তাঁকে দেখিওনি কিংবা তাঁর কাছ থেকে শুনিওনি। এই দিনে আমি বারবার নিজেকে জিজ্ঞেস করি, তিনি কি মারা গেছেন? যদি তাই হয়, তবে কে তাঁকে হত্যা করল এবং কেন? তাঁকে কি যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল? যখন শেষ হয়ে আসল তখন তিনি কার কথা ভাবছিলেন? তিনি কি তাঁর মায়ের কথা ভাবছিলেন যিনি তাঁর জন্য খাবার টেবিলে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? অথবা তিনি কি তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের কথা ভাবছিলেন যাদের তিনি ফেলে এসেছিলেন? আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন (জুন ২০০০)। আমি খুশী যে অবশেষে সন্তানের জন্য তাঁর দীর্ঘ ও কষ্টদায়ক প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার কাছে বিশাল ক্ষত তৈরী হয়েছিল যখন থেকে আমার ভাই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরও আমি কোন কষ্ট অনুভব করিনা। আমি বাঁচতে এবং শোকাবহ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছি। কিন্তু আমাদের প্রিয় স্বদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে আমার জন্য কঠিন হয় আমাদের দেশের করুণ অবস্থা আমার ব্যক্তিগত ক্ষতিকে ছাড়িয়ে গেছে। 
-   শমসের চৌধুরী ( দি ডেইলী স্টার, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৩)
মুনীর চৌধুরী পাকিস্তানী সরকারের দেয়া সিতার-ই-ইমরাজ উপাধি ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় পরিত্যাগ করেন



ড.এ.এন.এম. ফয়জুল মাহি
সিনিয়র লেকচারার, ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৩৯ সালে ফেনীতে জন্মগ্রহণকারী দীর্ঘকায়, সুদর্শন পুরুষ ডঃ ফয়জুল মাহি প্রগতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অন্যান্য সহকর্মীর মত তিনি অতটা উচ্চকন্ঠী ছিলেননা, কিন্তু তিনি মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তর্পনে সাহায্য করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিমগ্ন থাকা সত্যিই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর আসল পরিচয় তাঁর দেশদ্রোহী সহকর্মীদের কাছ থেকে গোপন করতে পারেননিঅসহযোগ আন্দোলন বা ৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় স্বায়ত্বশাসনের জন্য  জাতীয় আন্দোলন যা পরবর্তীতে দ্রুত স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ,  মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য নেতাদের অগ্নিঝরা নেতৃত্বে হয়েছিল, তা বেগবান করতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় তিনি সবসময় আমাদের সাথে ছিলেন। 
ব্যক্তিগতভাবে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ফয়জুল মাহি আমি যে এলাকায় বসবাস করতাম সেই একই এলাকায় তিনি বাস করতেন। আমরা প্রতিদিন ডিউটিএ অফিস রুম বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে মিলিত হয়ে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতাম। তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন একজন বিদ্বান ব্যক্তি। 

ডক্টরেট অফ এডুকেশন আর্জন করার পর মাহি ১৯৬৮ সালে ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশন এন রিসার্চে যোগদান করেন এবং অতি দ্রুত তিনি সিনিয়র লেকচারার পদে আসীন হন। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক।
বর্বর আল-বদর গ্রুপ তাঁকে ১৪ই ডিসেম্বর ভোরের প্রথম দিকে তাঁর আবাসিক কোয়ার্টার থেকে তুলে নেয় এবং তিনি কখনো পরিবারের কাছে ফিরে আসেননি। 
আসুন আজ আমরা এই নীরব কিন্তু নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি।   



ড. ফজলুর রহমান খান, সিনিয়র লেকচারার, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. ফজলুর রহমান ১৯৩৯ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁদের বিভাগে নীরব কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। তিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞানে এম.এস.সি ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৩ সালে ঐ বিভাগে যোগদান করেন। পরে তিনি  উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। সাথে সাথে তিনি তাঁর স্বীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। 
আমি তাঁকে একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক হিসেবে জানতাম, বর্তমান দিনের আমাদের তরুণ সহকর্মীদের মাঝে যা অত্যন্ত দুর্লভ গুণ।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ভয়াবহ রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেনা অভিযানের সময় তিনি নীলক্ষেত এলাকায় তাঁর বাসায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁর মৃতদেহ কয়েকদিন ফেলে রাখা হয়েছিল, পরবর্তীতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত সেনারা তা নিয়ে যায়।

সূত্রঃ অজয় রায় A Homage to my martyred colleague


মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী,  শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একজন নম্রভাষী এবং স্বভাবজাত লাজুক প্রকৃতির জনাব চৌধুরী আল-বদরদের হাতে খুন হতে পারেন তা ছিল কল্পনার বাইরে। তিনি কোন দিক দিয়েই সক্রিয় রাজনীতিবিদ বা জনগণের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেননা, তারপরও আল-বদর বাহিনী তাঁকে ১৪ই ডিসেম্বর তাঁর বাসা থেকে তুলে নেয় যেখানে তিনি লুকিয়ে ছিলেন। এটা এখন জানা গেছে যে, আল-বদর বাহিনী তাঁর ফুলার রোডস্থ বাসভবনে এসেছিল এবং তাঁর গৃহপরিচারককে জোর করে তুলে নেয় যে তাঁদের অনুপস্থিতিতে ঘর দেখাশোনা করত। গৃহপরিচারককে নির্যাতন করা হয় এবং আল-বদরের হত্যাকারী দলকে অধ্যাপকের গোপন স্থানে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।
জনাব চৌধুরী ছিলেন আমার প্রতিবেশী, ২৫শে মার্চের ভয়াবহ রাতের পূর্বে তিনি আমার বাসার ঠিক বিপরীতে বসবাস করতেনতারপর কার্ফিউ প্রত্যাহার হওয়ার সাথে সাথে আমরা ২৭শে মার্চ পৃথক হয়ে যাই। তিনি এতই দয়ালু ছিলেন যে, ঢাকায় আমার তেমন পরিচিত লোক বা আত্মীয় নেই জেনে তিনি আমাকে তাঁদের সাহায্যের প্রস্তাব দেন যা আমি নম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করি কারণ আমি চাইনি আমার মত রাজনীতিবিদক এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার একজন হিন্দুকে তাঁর সাথে রেখে তাঁকে আরো ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনি। 
১৯২৬ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণকারী জনাব চৌধুরী ১৯৫৫ সালে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে কয়েক বছর অধ্যায়ন করেন। তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাহিত্য ভারতী উপাধিতে ভূষিত হন তিনি ১৯৭০ সালে বাংলা বিভাগের রিডার হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখার মধ্যে রয়েছে বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার, রবি পরিক্রমা, কথ্য বাংলা, ভাষা ও সংস্কৃতি, সাহিত্যের নব রূপায়ন ইত্যাদি।



মোহাম্মদ মুরতাজা (ডাক্তার), মেডিক্যাল অফিসার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি কিভাবে তাকে ভুলতে পারি? আমি তাঁর কাছে ঋণী। তিনি আমাকে পাকিস্তানী বাহিনীদের হাতে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। আমি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের কোন এক সময় আমার এক ভাল বন্ধুর ধানমন্ডির এক আবাসিক বাসভবনে লুকিয়ে ছিলামকিছু সেনাসদস্য নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি জীপ দুপুর আড়াইটার দিকে আসল। তারা আমার আশ্রয়দাতা (যিনি পেশায় ছিলেন চিকিৎসক)কে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক লুকিয়ে আছেন কিনা সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করছিল। তিনি কোনভাবে তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন যে তেমন কেউ তার বাসায় নেই। প্রকৃতপক্ষে আমি সেই ফ্ল্যাটে ছিলামনা, আমি ছিলাম তার সাথে  কিন্তু মূল ভবনের সাথে সংযুক্ত একটি ছোট ফ্ল্যাটেআমার বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিলেন যে আমার জন্য ঐখানে থাকা নিরাপদ হবেনা কারণ সেনাবাহিনী আবার ফিরে আসতে পারে যদি তাদের কাছে সঠিক তথ্য থাকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, অন্ততঃ আজ রাতের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার। কারণ এখানে আসার আগে সেনাবাহিনী অবশ্যই আমার মূল বাসায় খোঁজ নেবে। সন্ধ্যায় কার্ফিউ পুনঃবলবৎ হওয়ার ঠিক পূর্বে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাট (তৎকালীন পরিত্যক্ত, নিস্তব্ধ ও ভয়ংকর শান্ত স্থান)-এ বিনা নোটিশে সরে গেলামকিন্তু ড. মুরতাজা, যিনি নিচের তলার আমার ফ্ল্যাটের ঠিক বিপরীতে বাস করতেন, আমার আগমন তাঁর জানালা থেকে প্রত্যক্ষ করলেন। সাথে সাথে তিনি আমার স্থানে এসে দরজায় করাঘাত করে আমাকে ফিসফিস করে দরজা খোলার জন্য বললেন। আমি কোন বাতি জ্বালালামনাতিনি আমাকে ঐ স্থান দ্রুত ত্যাগ করার পরামর্শ দিলেন, সম্ভব হলে আগামীকাল সকালে কার্ফিউ প্রত্যাহার হওয়ার সাথে সাথে। যখন আমি তর্ক করলাম যে যদি তিনি ঐখানে থাকতে পারেন তবে আমি কেন পারবনা, তিনি জবাব দিলেন যে তিনি নামকরা রাজনীতিবিদ ছিলেননা, তিনি ছিলেন মূলত মাওবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং একজন চিকিৎসক। তিনি আমাকে আরো পরামর্শ দিলেন যে যেহেতু এখনও পর্যন্ত আমি একটি নিরাপদ স্থানে যেতে পারিনি, আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া উচিৎ নয়, তিনি আভ্যন্তরীণ প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবেন। তিনি তাঁর একজন সাহায্যকারীকে আমার জন্য নিরাপদ স্থান খোঁজার জন্যও বললেনকয়েকদিন পর আমি ঐ বাড়ী ছেড়ে নতুন একটি গোপন স্থানে গেলাম। কিন্তু হায়, ডাক্তার পাকিস্তানী দোসরদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে নিজের পরিচয় লুকাতে পারলেননাতারা জানত যে একজন নিরীহ ডাক্তারের ছদ্মবেশে এই ভদ্রলোক শহরের অভ্যন্তরে অপারেশন চালানো আহত গেরিলাদের চিকিৎসার মাধ্যমে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জরুরী ঔষধপত্র সরবারাহ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতেন
১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল সেন্টারে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেনতিনি ছিলেন একজন আন্তরিক লেখক, একজন নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হচ্ছে, চিকিৎসা শাস্ত্রের কাহিনী, প্রাচীন ভিজনানের কাহিনী, হুনানের কৃষক আন্দোলন, পাক-ভারতের যুদ্ধের তাৎপর্য, জনসংখ্যা ও সম্পদ, শান্তি না শক্তি১৪ই ডিসেম্বর একদল আল-বদর বাহিনী দ্বারা তাঁকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে তুলে নেয়া হয়। তাঁর আদরের ছোট মেয়ে মিতির ওড়না দিয়ে তাঁকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। 
আমি শুধুমাত্র আমার একজন অসাধারণ বন্ধুকেই হারাইনি বরং আমার জীবনের একটি অত্যন্ত সংকটময় মূহুর্তে একজন সত্যিকারের শুভাকাঙ্খীকেও হারিয়েছি। আমি কিভাবে তাঁকে কখনো ভুলতে পারব!


মুহাম্মদ সাদাত আলী, লেকচারার ইন এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সত্যি বলছি, আমি তাঁর সম্বন্ধে বেশী কিছু জানতামনা, যদিও আমার মধ্যে সামান্য পরিচয় ছিল। ১৯৪২ সালের ২৮শে জানুয়ারী জন্মগ্রহণকারী, তিনি নরসিংদী জেলার অধিবাসী। American Colorado State College থেকে ডক্টর অফ এডুকেশন ডিগ্রী অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর জনাব সাদাত ১৯৭০ সালের কোন এক সময় আইইআর এ যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পূর্বে তিনি নরসিংদী কলেজে অধ্যাপক ছিলেন। 
১৯৭১ সালের ২৬শে এপ্রিল সম্ভবতঃ তিনি গ্রামের বাড়ীর উদ্দ্যেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তারপর থেকে তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে শোনা গিয়েছিল যে নরসিংদী যাওয়ার পথে সম্ভবতঃ তাঁকে সেনাবাহিনী দ্বারা গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়।


মুহাম্মদ সাদেক, প্রধান শিক্ষক ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল
জনাব সাদেক ১৯৩৯ সালে ভোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ফুলার রোড এলাকায় ১১ নং ভবনের নিচ তলায় বাস করতেন। 
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ সকালে কারফিউ চলাকালীন সেনাবাহিনী আমাদের এলাকায় অভিযান চালায় এবং জনাব সাদেকের ঘরে জোরপূর্বক প্রবেশ করে। সাথে সাথেই তিনি তাঁর পরিচয় প্রকাশ করার পূর্বে তাঁকে গুলি করা হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণরত অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তাঁকে তাঁর বাসায় ফেলে যাওয়া হয়পরিশেষে তাঁর ভয়ংকর আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 
২৭ তারিখ সকালে যখন কার্ফিউ কয়েক ঘন্টার জন্য প্রত্যাহার হল, তাঁর দেহ ভবনের ঠিক পেছনের সীমানায় মাটি দেয়া হয়।

সূত্রঃ অজয় রায় A Homage to my martyred colleague


রাশেদুল হাসান, ইংরেজী বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমার খুব ভাল একজন বন্ধু রাশেদুল হাসান ১৯৩২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন যা ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসনাধীন উপমহাদেশের এই অংশে স্থানান্তরিত হয়তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে বি.এ. (অনার্স) এবং ইংরেজীতে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি নরসিংদী, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে পাঠদান করেনসর্বশেষে ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। রাশেদুল একজন ভাল বক্তা ছিলেন ডিইউটিএ সভার বহু অনুষ্ঠানে তাঁর সুচিন্তিত অনবদ্য বক্তৃতা তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছিল। 
তিনি মুক্ত গণতন্ত্রমনা এবং মৌলবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে আজীবন যোদ্ধা ছিলেন। 
আনোয়ার পাশার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশেদুল হাসানকে তাঁর বন্ধু আনোয়ার সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর একই ভবন থেকে তুলে নেয়া হয়ঐসময় দুই পরিবার ক্যাম্পাসের ভেতরে ঈসা খাঁ রোডের একটি ফ্ল্যাটে একই সঙ্গে বসবাস করত      


শরাফত আলী, প্রভাষক গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণিত বিভাগে আমার একজন প্রাক্তন ছাত্র এবং অধস্তন সহকর্মী কার্জন হল এলাকার নিকটবর্তী ঢাকা হলের বিপরীতে  পরিচালিত ভোররাতের সেনা আপারেশন (অপারেশন সার্চলাইট) এ সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হনশরাফত তখন ছাত্রদের ভবনের ডাইনিং হলের সাথে সংযুক্ত দুইতলার একটি ভবনে অধস্তন ও অবিবাহিত শিক্ষকদের জন্য কক্ষগুলোর একটি কক্ষে বসবাস করতেনতিনি তাঁর কক্ষে জোরপূর্বক আগমণকারী একদল সেনাসদস্য দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হনসেনাসদস্যরা নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁর মৃতদেহ তাঁর সহকর্মী জনাব খান কাদিমের সাথে কয়েকদিন অবহেলায় ফেলে যাওয়া হয়। 
১৯৪৩ সালে জন্মগ্রহণকারী শরাফত কুমিল্লার অধিবাসী ছিলেনতিনি ১৯৬৬ এবং ১৯৬৭ সালে গণিতে যথাক্রমে বি.এস.সি (স্নাতক) ও এম.এস.সি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁকে ১৯৬৮ সালে গণিতের প্রভাষক  এবং পরবর্তীতে ঢাকা হলের সহকারী গৃহশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। 
কে ভেবেছিল একজন শান্ত ও নম্র স্বভাবের নির্দোষ ছেলে, একজন সম্ভাবনাময় অসাধারণ শিক্ষক আমাদের স্বাধীনতার পরিবর্তে উৎসর্গিত হবে? আমরা কিভাবে ঐসব যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করব?
কিন্তু আমরা ক্ষমা করেছি এবং ঐসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছি। শুধু তাই নয়, হয়ত এমন দিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে যখন ঐসব অপরাধীদের তথাকথিত পাকিস্তান ভাঙ্গন রোধের জন্য প্রশংসা বা আরাধনা করতে হবেকেন নয়, যদি আজ যুদ্ধাপরাধীরা সরকারের ভেতরে ক্ষমতায় ভাগ বসাতে পারে? এটা কি কোন অবাস্তব ভাবনা?



সূত্রঃ অজয় রায় A Homage to my martyred colleague


সন্তোষ ভট্টাচার্য, সিনিয়র লেকচারার, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বুড়িগঙ্গা নদীর ঠিক অপর পার্শ্বের যন্ত্রাইল নামক গ্রামের বিখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান জনাব সন্তোষ ভট্টাচার্য ১৯১৫ সালের ৩০শে আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত ভাষা ও শিক্ষায় জ্ঞানের জন্য পরিবারটি সুপরিচিত ছিল। জনাব সন্তোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭-৩৮ সালে ইতিহাসে তাঁর বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। জেএন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে ১০ বছর কাজ করার পর তিনি ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কয়েক বছর পর তিনি সিনিয়র প্রভাষক হন। 
বন্ধুমহলে সন্তোষ বাবু নামে জনপ্রিয় জনাব সন্তোষ  বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞানের জন্য পরিচিত ছিলেন ইংরেজী এবং বাংলাতেও তাঁর একটি শক্তিশালী লেখনী ছিল। ভারতীয় ইতিহাসের মৌর্য সভ্যতার ওপর কৌতিল্যর অর্থশাস্ত্র( কৌতিল্যর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি)-এর ওপর বিশেষ দক্ষতা সহ চাণক্যের কাজের ব্যাপারে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। 
২৫শে মার্চের ভয়াবহ রাতের সেনাবাহিনীল হামলার পর সন্তোষ বাবু সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়ীতে চলে যান। তিনি স্বচোক্ষে সেনা অপারেশনের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর ঘরে বসে থাকার সাহস করেননি কারণ সেনাবাহিনীর নির্দেশন অনুসারে একজন বিশ্বস্ত নাগরিক হিসেবে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বিশ্ববিদ্যালয় বাসভবনে ফিরে যেতে হততাঁর বন্ধুরা তাঁকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন যে ক্যাম্পাসে থাকা তাঁর জন্য নিরাপদ নয়তাঁরা তাঁকে ভারতে পাড়ি দিতেও অনুরোধ জানালেন যা জনাব ভট্টাচার্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে, আমি আমার মাতৃভূমি ত্যাগ করবনা, কেন আমি তা করব? আমি কোন অপরাধ করিনি। তাঁর সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে মূল্য দিতে হয়েছিল। ১৪ই ডিসেম্বর অন্যান্য সহকর্মীর সাথে আল-বদর বাহিনী তাঁকে তাঁর ঈসা খাঁর বাসভবন থেকে তুলে নেয়। রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তাঁর ছিন্নভিন্ন দেহ তাঁর বন্ধুরা আবিষ্কার করেন। 
সন্তোষ ভট্টাচার্য ঢাকা হলে আমার একজন সন্মানিত শিক্ষক ছিলেন। তাঁর প্রতি আমার প্রচন্ড শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল। ১৯৫৪-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি আমাদের গৃহশিক্ষক ছিলেন। মুক্ত হস্ত ও হৃদয়ের তিনি একজন অত্যন্ত ভালবাসার মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের সাথে বয়স এবং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে খুব সহজেই মিশতে পারতেন


সিরাজুল হক খান, সিনিয়র লেকচারার ইন এডুকেশন, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডঃ সিরাজুল হক খান ১৯২৪ সালে নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে এডুকেশনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন এবং পরে তিনি ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর থেকে এম.এড. ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে তিনি ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কলেজ অফ কলোরাডো থেক ডক্টর অফ এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন, তারপর পরের বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। সত্যি কথা বলতে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একই এলাকায় বসবাসকারী প্রতিবেশী হিসেবে আমার তাঁর সাথে সামান্যই পরিচয় ছিল। 
১৪ই ডিসেম্বর ভোরে আল-বদর বাহিনীর একদল সদস্য তাঁকে জোর করে একটি বাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় যেখান থেকে তিনি তাঁর প্রিয় পরিবারের কাছে আর ফিরে আসেননি। নির্দয় সহযোগী (জামাতি ও মুসলিম লীগার) - রা তাকে হত্যা করে, হ্যাঁ অসাধারণ ও সৎ এই ব্যক্তিকে হত্যা করে।      
সূত্রঃ অজয় রায় A Homage to my martyred colleague


সূত্রঃ http://bit.ly/dGA5cA
জহির রায়হান
জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক ১৯৩৫ সালের ১৯শে আগষ্ট ফেনী জেলার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জহির রায়হান ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং ঢাকা কলেজে ভর্তি হন, যেখান থেকে তিনি আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ. (অনার্স) ডিগ্রী লাভ করেন।
প্রথমদিকে তিনি কম্যুউনিস্ট আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট ছিলেন। যখন কম্যুউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয় এবং দলটির নেতারা আত্মগোপনে চলে যায়, তিনি বার্তাবাহক হিসেবে চিঠিপত্র ও সংবাদ আদান-প্রদান করতেন। তিনি আত্মগোপনকারী নেতাদের কাছ থেকে রায়হান নাম অর্জন করেন এবং এই কারণে তাঁর মূল নাম জহিরুল্লাহ্ পরিবর্তিত হয়ে জহির রায়হান হয়।
ছাত্রজীবনে জহির সাহিত্যের প্রতি নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ সূর্যগ্রহণ নামের একটি গল্পসমগ্র বাংলা ১৩৬২ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর লিখিত অন্যান্য বইসমূহ হচ্ছে শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী এবং আর কটা দিন। ১৯৭০ সালে ইংরেজী সাপ্তাহিক weekly express প্রকাশে তিনি একজন অন্যতম উদ্যেক্তা ছিলেন।
১৯৫২ সালে জহির ফটোগ্রাফি শেখার জন্য কোলকাতা গমন করেন এবং প্রমোতেষ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফী স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫৬ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি কখনো আসেনি মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। তারপর একের পর এক কাজল, কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া , আনোয়ারা, সংগ্রাম ও বাহানা মুক্তি পায়। জীবন থেকে নেয়া পাকিস্তানের স্বৈরশাসন তুলে ধরেছিল এবং জনগণকে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি একটি ইংরেজী চলচ্চিত্র Let there be light নির্মাণ শুরু করেন, যা তিনি শেষ করতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর তিনি কোলকাতায় যান এবং একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র Stop Genocide প্রযোজনা করেন যা পাকিস্তানী সেনাদের দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরে। 
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে কুখ্যাত আল-বদরের কিছু সদস্য জহিরের বড় ভাই বিখ্যাত লেখক শহীদুল্লাহ্‌ কায়সারকে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়কিছুদিনের মধ্যে, ১৯৭১ সালের ৩০শে ডিসেম্বর একজন জহিরকে মিরপুরের কোন একটি স্থানের একটি ঠিকানা সম্বন্ধে জানাল, যেখানে তিনি তাঁর ভাইকে খুঁজে পেতে পারেন। ঐ সূত্র ধরে জহির তাঁর ভাইকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। হায়, তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।


শহীদুল্লাহ্‌ কায়সার
সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক, যিনি ১৯২৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম ছিল আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌।
১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম.এ. তে ভর্তি হন, কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষা তিনি দিতে পারেননি। ছাত্র হিসেবে তিনি নানারকম সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক কম্যুউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন।
শহীদুল্লাহ্‌ কায়সার ১৯৪৯ সালে ঢাকায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সাথে সাংবাদিকতায় তাঁর পেশাজীবন শুরু করেন১৯৫৮ সালে তিনি সহযোগী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাজ করে গেছেন।
শহীদুল্লাহ্‌ কায়সার একজন উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিকও ছিলেন। তিনি সারেং বৌ (১৯৬২) এর মাধ্যমে জনসমক্ষে আবির্ভূত হনপরে এই বইয়ের ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, সংসপ্তক (১৯৬৫), যা পরে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি টিভি ধারাবাহিক হিসেবে নির্মিত হয়, কৃষ্ণচূড়া মেঘ, তিমির বলয়, দিগন্তে ফুলের আগুন, সমুদ্র ও তৃষ্ণা, চন্দ্রভানের কন্যা, সংসপ্তক ও অসমাপ্ত উপন্যাস, কবে পোহাবে বিভাবরী। শহীদুল্লাহ্‌ আদমজী সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৬২) ও বাংলা একাডেমী পুরষ্কার (১৯৬২) গ্রহীতা। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং তিনি কখনো ফিরে আসেননি।

আনোয়ার পাশা
১৯২৮ সালের ১৫ই এপ্রিল ভারতের মুর্শিদাবাদের দেবকাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে উচ্চ মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় বি.এ. এবং পরে এম.এ. তে অধ্যায়ন করতে যান। তিনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে মানিকচক উচ্চ মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন এবং পরে ভবতা আজিজিয়া উচ্চ মাদ্রাসায় (১৯৫৪) এবং সদিখন দিয়ার বহুমুখী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (১৯৫৭) শিক্ষাদান করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এবং পরে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন
আনোয়ার পাশা লেখক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু করেন সাহিত্যিক রচনাবলীর সংগ্রহ হাসনাহেনা-র মাধ্যমে। পরবর্তী দুই যুগ ধরে তিনি উপন্যাস, রচনা, কবিতা ও ছোট গল্প প্রকাশ করেন। তিনি চারটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতার সম্পাদনাও করেছেন। তাঁর লেখাগুলো কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পাক্ষিক কবিতা সহ বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে নদী নিঃশ্বেসিত হলে(১৯৬৩), নিদ সন্ধানী (১৯৬৮), নিশুথি রাতের গাঁথা (১৯৬৮), নিরুপায় হরিনী (১৯৭০), রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা ( ১ম খন্ড ১৯৬৩, দ্বিতীয় খন্ড ১৯৭৩), সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল (১৯৬৮)।
আনোয়ার পাশাকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবিদের সাথে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সাহিত্যে তাঁর অর্জনাবলীর জন্য তিনি মরণোত্তর বাংলা একাডেমী পুরষ্কারে সন্মানিত হন।


গিয়াসউদ্দীন আহমেদ
গিয়াসউদ্দীন আহমেদ ১৯৩৫ সালে নরসিংদীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় এবং ১৯৫২ সালে নটরডেম কলেজ থেকে আই.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হনতিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বি.এ. (অনার্স) এবং এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং পরে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্য গমন করেন এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে বিশ্ব ইতিহাসের ওপর স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকদিন পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে আবার তাঁকে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী দ্বারা মহসিন হল থেকে তাঁকে তুলে নেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারী তাঁর কাপড়-চোপড় এবং বিকলাঙ্গ দেহ মিরপুর এলাকায় সনাক্ত করা হয়।

মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী
ডঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ১৯৩২ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকে তিনি একজন তুখোড় ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যট্রিকুলেশন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই্.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এমবিবিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকারের জন্য তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহকারী সার্জন হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৯-৬০ সালে তিনি মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ইংল্যান্ডের এডিনবার্গ থেকে কার্ডিওলজিতে এমআরসিপি ডিগ্রী অর্জন করেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ঐ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ইংল্যান্ড থেকে জেনারেল মেডিসিনের ওপর এমআরসিপি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি একইসাথে মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। 
তিনি একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি সর্বপ্রথম মানুষ-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা সম্বন্ধে কথা বলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণার কাজও করতেন। তাঁর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধসমূহ ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়তিনি মেডিসিনের ওপর একটি বই লেখা শুরু করেছিলেন কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি
ডঃ ফজলে রাব্বী ১৯৫৭ সালে বিয়ে করেন। তিনি একটি পুত্র ও একটি কন্যার গর্বিত বাবা হন। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী ডঃ জাহানারা রাব্বীর বক্তব্য ছিল নিম্নরূপঃ
 ১৫ই ডিসেম্বর কার্ফিউ দুই ঘন্টার জন্য শিথিল করা হয়েছিল। স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি একজন অবাঙ্গালী রোগীকে দেখতে ঢাকার পুরোনো অংশের দিকে গেলেন। ফিরে আসার পথে তিনি প্রচুর শাকসব্জী কিনেছিলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বারবার ৭৫ সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বললেও তিনি রাজী হননি। সেই হতভাগ্য দিনে দুপুরের খাওয়ার পর তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। বিকেলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, আল-বদর এবং রাজাকারের সদস্যরা তাঁর বাড়ী ঘিরে ফেলে। তারা একটি মাইক্রোবাস ও একটি জীপে করে এসেছিল। প্রায় ছয়জন সৈন্য তাঁকে জীপের দিকে নিয়ে গেল। যখন তাঁর স্ত্রী দৌড়ে বের হয়ে আসছিলেন তারা তাঁর দিকে অস্ত্র তাক করল এবং আর সামনে অগ্রসর হতে বাধা দিল। ডঃ রাব্বী মাথা উঁচু করে জীপের দিকে হেঁটে গেলেন। এটা জানা গিয়েছিল যে ১৫ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে অন্যান্য বুদ্ধিজীবিদের সাথে ডঃ রাব্বীকে ট্রাকে করে লালমাটিয়ার শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট থেকে রায়েরবাজার ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং এক নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৮ই ডিসেম্বর তাঁর মৃতদেহ সনাক্ত করা হয়।

(ডঃ ফজলে রাব্বির মৃতদেহ)


সেলিনা পারভীন
সেলিনা পারভীন ১৯৩১ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন কবি ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ফেনীতে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উৎসুক পাঠকে পরিণত হন। সাপ্তাহিক ললনা তে তিনি চাকুরী নেন। তারপর তিনি তাঁর নিজস্ব সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপি শুরু করেন। তিনি কবিতা, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ লেখাও শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদরের হাতে তিনি নিহত হন।


নিজামুদ্দীন আহমেদ
নিজামুদ্দীন আহমেদ ১৯২৯ সালে মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। পরে তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল-এ যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পিপিআই-এর সম্পাদক হন এবং জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
নিজামুদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অত্যন্ত উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী শক্তির হত্যাযজ্ঞের বিভিন্ন খবরাখবর বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে  পাঠাতেন। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ম্যাকব্রাউনকে প্রকৃত খবর সংগ্রহের জন্য একটি গেরিলা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলেনতিনি বিবিসিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের সাথে  প্রকৃত সংবাদ সরবরাহ করেন । এই কারণে তাঁকে দুইবার জেনারেল রাও ফরমান আলীর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১২ই ডিসেম্বর নিজামুদ্দীন যখন দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন, তখন আল-বদর সদস্যরা তাঁকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর দেহ কখনো পাওয়া যায়নি।


কামিনীকুমার ঘোষ
কামিনীকুমার ঘোষ ১৮৮৮ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে তিনি রায়সাহেব কামিনীকুমার ঘোষ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সকল পরীক্ষায় বৃত্তির সাথে উত্তীর্ণ হন। তিনি ২৮ বছর যাবত চট্টগ্রাম জেলা বোর্ডের সদস্য ও এর সহ-সভাপতি হিসেবে ৭ বছর কাজ করেনতিনি স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোর সাথেও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। কাঞ্চনা ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ২৫ বছর কাজ করেন। তিনি সাতকানিয়ায় বহু সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাতকানিয়া কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। আইনজীবি হিসেবে তিনি ৫০ বছর কাজ করেন। 
১৯৭১ সালের ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।


মেহেরুন্নেসা
মেহেরুন্নেসা ১৯৪৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থী হিসেবে তিনি স্থানান্তরিত হন এবং ঢাকার মিরপুরে স্থায়ী নিবাসী হন। তিনি বহু সংবাদপত্রে প্রুফরিডার হিসেবে কাজ করেছেন ছোটগল্প ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রথম কবিতা চাষী ১৯৫২ সালে দৈনিক সংবাদের খেলাঘর পাতায় প্রকাশিত হয়। 
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তিনি কিছু অবাঙ্গালী মানুষের হাতে মিরপুরে নিহত হন।

সৈয়দ নাজমুল হক
সৈয়দ নাজমুল হক ১৯৪১ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যথাক্রমে বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গর্ভর্নর আবদুল মোনেম খান উপস্থিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইনফর্মেশন সার্ভিসের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার পুলিশী মামলার কারণে তাঁকে ঐ চাকুরীতে যোগ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। 
পরে তিনি সাংবাদিকতাকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের প্রধান রিপোর্টার এবং কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের ঢাকা সংবাদদাতা নিযুক্ত হনআগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অগ্রগতি নিয়ে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরী করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিতি হত্যাকান্ড সম্বন্ধে খবরাখবর পাঠান। ১৯৭১ সালের ৬ই আগষ্ট তাঁকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কারাগারে প্রেরণ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিচারে তাঁকে স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে নভেম্বরে মুক্তিলাভের পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা তাঁকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। তাঁর মৃতদেহ কখনো পাওয়া যায়নি।    



বুদ্ধিজীবি হত্যার পেছনে দায়ী মূল ব্যক্তিবর্গঃ

১. মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী (পাকিস্তান সেনাবাহিনী)
২. গোলাম আযম (জামাতে ইসলামী)
৩. মতিউর রহমান নিজামী (প্রধান-জামাতে ইসলামী)
৪. মাওলানা মান্নান (জামাতে ইসলামী)
৫. চৌধুরী মইনউদ্দীন (জামাতে ইসলামী)
৬. খালেক মজুমদার (জামাতে ইসলামী)
৭. দেলোয়ার হোসেন সাঈদী (জামাতে ইসলামী)
৮. সিআইএ এবং আইএসআই


0 comments:

Post a Comment